বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আলোচনায় একটি দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যেটি হলো বিএনপির ধারাবাহিক সমালোচনার মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামী আবারও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসা। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা নতুন কিছু নয়, কিন্তু আক্রমণ যত ঘন হয়, সে প্রতিপক্ষই অনেক সময় আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করে। বাংলাদেশি রাজনীতির মাঠেও সেই পুরনো বাস্তবতাই যেন আবার দৃশ্যমান।
বিএনপি গত কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন বক্তব্য, সমাবেশ, বিবৃতি ও গণমাধ্যমে জামাতের বিরুদ্ধেই তুলনামূলক বেশি শব্দ ব্যয় করছে। সেসব বক্তব্যে সমালোচনা প্রধান হলেও, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যে দলকে রাখা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে জামাত। ফলে রাজনৈতিক তত্ত্বের একটি সাধারণ সূত্র আবারও কার্যকর হচ্ছে “যাকে যত বেশি আক্রমণ করা হয়, তাকে ভুলে যাওয়া যায় না, বরং সেই আলোচনার অংশ হয়ে ওঠে।”
অনেকের মতে, বিএনপির কৌশল ভিন্নমত, জোট রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচনী সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার উদ্দেশ্যে হতে পারে। আবার অন্যদের মতে, সমালোচনার তীব্রতা বিএনপির নিজস্ব অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টাও হতে পারে। তবে যাই হোক ফলাফলটি একই, জামাত এখন আলোচনার একটি সক্রিয় উপাদান।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে এটি নতুন নয় বাংলাদেশে বহুবার দেখা গেছে, কোনো দলকে যখন মূলধারার বিরোধী পক্ষ বেশি আক্রমণ করে, তখনই সেই দলটি গণমাধ্যম ও জনমতের আলোচনায় আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
এই বাড়তি দৃশ্যমানতার একটি স্বাভাবিক পরিণতি হলো নির্বাচনী প্রভাবের প্রশ্ন। আলোচনায় থাকা মানেই নির্বাচনের আগে জনমনে একটি অবস্থান তৈরি হওয়া।
জামাত নিয়ে যত বিতর্ক বাড়ছে, পরোক্ষভাবেই দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি, ভোটব্যাংক এবং মাঠ পর্যায়ের সক্রিয়তার বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় আসছে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে জামাতের রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাব আগে থেকেই ছিল, সেসব এলাকায় এই আলোচনাগুলো নির্বাচনী সমীকরণে নতুন চাপ তৈরি করতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপির ঘনঘন সমালোচনা কৌশলগত হোক বা প্রতিক্রিয়াশীল। ভোটারদের মনে প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে “যাকে এত বলা হচ্ছে, সে কি মাঠে নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করছে?”
এই ধরনের প্রশ্নই নির্বাচনী প্রভাবের জন্ম দেয়।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। বিএনপি ও জামাতের ইতিহাস ঘনিষ্ঠতা ও দূরত্ব দুই ধারারই। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন এবং আগ্রহ দুটোই বাড়ছে। সমালোচনা যত জোরালো হচ্ছে, জনমতের প্রশ্নও তত বাড়ছে “সমালোচনা কেন এত বাড়ছে?”
এই প্রশ্নগুলোই মূলত জামাতকে আলোচনার কেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছে।
রাজনীতিতে দৃশ্যমানতা একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। কেউ ইতিবাচক কারণে আলোচনায় আসুক বা নেতিবাচক কারণেই আসুক, আলোচনায় থাকা মানেই সক্রিয় থাকা। তাই বিএনপির সমালোচনার ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি জামাতের নামকে রাজনৈতিক পটভূমিতে আরও দৃশ্যমান করে তুলছে, এটা বলাই যায়।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো চিরন্তন একটি খেলা, যেখানে সমালোচনার আগুন মাঝে মাঝে প্রতিপক্ষের দিকেই আলো ছড়িয়ে দেয়। বিএনপি যে উদ্দেশ্যেই সমালোচনা করুক, বাস্তবতা হলো, এই সমালোচনাই জামাতকে বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে দিয়েছে এবং এর নির্বাচনী প্রতিক্রিয়াও ভবিষ্যতের রাজনীতিতে সমানভাবে প্রতিফলিত হতে পারে।
এটি কৌশলগত সফলতা নাকি অনিচ্ছাকৃত ফল, সময়ই তার চূড়ান্ত উত্তর দেবে।
মারুফ হোসেন
প্রকাশক ও সম্পাদক
আজকের তালাশ