অতিথি কলাম

বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ

  প্রতিনিধি ১৩ এপ্রিল ২০২৫ , ৭:১৫:০২ প্রিন্ট সংস্করণ

0Shares

◾বাহাউদ্দিন গোলাপঃ

বছরের প্রথম প্রহরে সূর্য যখন উদিত হয়, বাতাসে ভেসে বেড়ায় কাঁচা আমের গন্ধ, গ্রামীণ পথজুড়ে বাজে ঢাক-ঢোল আর মুখরিত হয় “এসো হে বৈশাখ” গানে—তখন শুরু হয় বাঙালির প্রাণের উৎসব, পহেলা বৈশাখ। এটি শুধু একটি দিন নয়, বরং বাঙালি চেতনার এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ; যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষি, ব্যবসা ও ভালোবাসা একাকার হয়ে যায়।

 

♦️ ইতিহাসের পাতায় নববর্ষ

বাংলা সনের উৎপত্তি সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে (১৫৫৬–১৬০৫), খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। তখনকার হিজরি চন্দ্রসন কৃষিভিত্তিক রাজস্ব আদায়ের জন্য উপযুক্ত ছিল না, ফলে প্রবর্তিত হয় ফসলি সন। একে ভিত্তি করে গণনা শুরু হয় বাংলা সনের, যার জনক হিসেবে আবুল ফজল ও তোদরমলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৫৮৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়া এই বর্ষপঞ্জি সময়ের পরিক্রমায় হয়ে ওঠে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।

 

পহেলা বৈশাখে খাজনা আদায়, ‘হালখাতা’ উদযাপন ও ব্যবসায়িক খাতার নতুন বছরের সূচনা ছিল প্রথাগত। প্রজারা নতুন পোশাকে খাজনা দিতেন, আর ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করাতেন নতুন খাতার পাতায়। সময়ের আবর্তে এ প্রথাই হয়ে ওঠে লোকজ উৎসবের এক অনন্য রূপ।

 

♦️ নগরে উৎসব, গ্রামে প্রাণ

ঢাকা শহরের রমনা বটমূলে ছায়ানটের গানে নববর্ষের সূচনা হয় প্রায় ছয় দশক ধরে, যা প্রথম শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। পাকিস্তানি শাসনামলের সাংস্কৃতিক দমননীতির বিরুদ্ধে এ ছিল এক সাহসী সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মঙ্গল শোভাযাত্রা যোগ করে এক ভিন্নমাত্রা—যা ২০১৬ সালে ইউনেসকোর ‘Intangible Cultural Heritage of Humanity’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যদিও সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটি এখন ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পালিত হচ্ছে।

এই উৎসবের প্রাণ থাকে গ্রামে—সকালের পান্তা-ইলিশ, আলপনা আঁকা উঠোন, লাল-সাদা শাড়ি-পাঞ্জাবি, স্থানীয় মেলা, নাগরদোলা, কুমোর-পাটুয়ার হাট—সব মিলিয়ে এক সর্বজনীন আনন্দঘন পরিবেশ।

 

♦️ সমাজ-সংস্কৃতি ও লোকজ আবহে নববর্ষ

পহেলা বৈশাখ বাঙালির জীবনে শুধু আনন্দের দিন নয়, বরং এক আত্মপরিচয়ের দিন। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে এটি এক অসাম্প্রদায়িক মিলনের প্রতীক। গ্রামাঞ্চলে এই দিনে পালা গানের আসর বসে, পটচিত্র আঁকা হয়, মুখোশে মুখ ঢেকে শিশু-কিশোরেরা মেতে ওঠে খেলায়।

পহেলা বৈশাখ ঘিরে বাংলার নাট্য, সংগীত ও শিল্পকলায় সৃষ্টি হয়েছে নানান ধারার—যেমন গ্রামীণ যাত্রা, বৈশাখী নাটক, লোকনৃত্য, পল্লীগীতি ও ছড়ার ধারা। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষভিত্তিক সাহিত্যের আলাদা প্রবাহ।

 

♦️ নববর্ষের রন্ধন ও রীতিনীতি

এই দিনে প্রচলিত থাকে পান্তা-ভাত, ইলিশ মাছ, ভর্তা, লাল শাক, কাচা আমের ডাল, নানা পিঠা-পায়েসের আয়োজন। বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে কিছু না কিছু ভিন্নতা থাকলেও সার্বজনীন যে ঐক্য—তা হলো ‘নতুনের আনন্দ’। হালখাতা অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাকে মিষ্টি খাইয়ে দেন, দেন উপহার। কৃষক তার ফসলের নতুন বীজ বুনে দেয় মাঠে। গৃহবধূ আলপনা আঁকে উঠোনে। শিশু-কিশোররা উড়িয়ে দেয় রঙিন ফানুস। চট্টগ্রামে বৈসাবি উৎসব, রাজশাহীতে পালা গান, খুলনার গ্রামীণ মেলায় লাঠিখেলা—সবই নববর্ষকে করে তোলে আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের এক অভিন্ন মিলনমেলা।

 

♦️ সময়ের রূপান্তর ও আধুনিকতা

বৈশাখ আজ শহুরে ব্যস্ত জীবনের মাঝেও স্থান করে নিয়েছে উৎসবের রূপে। তবে এর বাণিজ্যিকরণ ও অতি আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকটাই লোকজ রূপ হারিয়ে যেতে বসেছে। পান্তা-ইলিশ এখন রেস্তোরাঁর বিলাসিতা, আলপনার জায়গায় এসেছে ডিজিটাল ব্যানার। টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এ উৎসব যেন হয়ে উঠেছে ফটোশ্যুট কেন্দ্রিক।

তবুও মানুষের প্রাণের টান—নতুনকে বরণ করে নেওয়ার যে অনন্ত আকুতি, তা আজও নববর্ষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। হৃদয়ের গভীরতা থেকেই মানুষ এই দিনটিকে পালন করে।

 

♦️ নববর্ষে নতুন প্রতিশ্রুতি

নতুন বছরের সূর্যোদয় কেবলমাত্র সময়ের পরিবর্তন নয়, বরং নিজের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দেয়া। এই দিনটিতে পুরোনো গ্লানি, হিংসা, ক্লেশ ভুলে গিয়ে ‘সব গ্লানি দূর হোক, ধুয়ে যাক সব জরা’—এই কামনায় শুরু হয় নতুন যাত্রা। বাঙালি হৃদয় আশায় বুক বাধে—নতুন বছর আনবে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌভ্রাত্রের বারতা।

 

♦️ শেষ কথা

পহেলা বৈশাখ কেবল ক্যালেন্ডারের নতুন পৃষ্ঠা নয়। এটি বাঙালির নিজস্ব রঙ, গন্ধ, সুর ও স্পন্দনের দিন। এটি আমাদের শিকড়, আমাদের আত্মার উৎসব। যতদিন বাংলা ভাষা বাঁচবে, বাঙালি জাতিসত্তা টিকে থাকবে—ততদিন বৈশাখ আসবে, প্রাণের উৎসব হয়ে ফিরে আসবে পহেলা বৈশাখ।

সবাইকে পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা।
শুভ নববর্ষ ১৪৩২।

লেখক:
মো: বাহাউদ্দিন গোলাপ
ডেপুটি রেজিস্ট্রার
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

0Shares

আরও খবর

Sponsered content