প্রতিনিধি ২২ অক্টোবর ২০২৫ , ৩:২১:৫৫ প্রিন্ট সংস্করণ
*প্রশাসনের অভিযান ব্যর্থ~প্রতিদিন ট্রলার ও স্পিডবোটে আসে মাছ~চার পয়েন্টে সক্রিয় সিন্ডিকেট~প্রশাসনের ওপর হামলার নেপথ্যেও এই চক্রের ইন্ধন*
তালাশ প্রতিবেদক॥
বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের চর কেউটিয়া গ্রামে হাট বসিয়ে চলছে প্রকাশ্যে মা ইলিশ বিক্রির মহোৎসব। নিষেধাজ্ঞার এই মৌসুমে প্রশাসনের অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ চক্র দিনের আলোয়ই অবাধে মা ইলিশ বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চর কেউটিয়া গ্রামের চারটি স্পটে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে অবৈধ ইলিশ কেনাবেচা। নিজাম হাওলাদারের বাড়ি, কবির সিকদারের বাড়ি, মিরাজ মেরদারের বাড়ি এবং আলামিন সিকদারের বাড়ি—এই চারটি স্থানে প্রতিদিনই নদী ও আশপাশের এলাকার জেলেরা মা ইলিশ নিয়ে আসে। তখন ডাকের মাধ্যমে, খুচরা বা পাইকারি বিক্রি করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব বাড়ির সবাই বিক্রির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং একাধিক ব্যক্তি তাদের মাধ্যমে পাইকারি ব্যবসা পরিচালনা করছে। চর কেউটিয়া এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, কামাল খলিফা, মেহেদি, জামাল খলিফা, রিয়াজ সিকদার, রাজন সিকদার, জসিম হাওলাদার, আনিছ সিকদার, সমীর সরদার, হুমায়ুন সিকদার, মামুন সিকদার, হিরন সিকদার, জাকির খলিফা, সুমন সিকদার, পলাশ মল্লিক ও সহিদ মল্লিকসহ আরও ২০ থেকে ৩০ জন ব্যক্তি দিনের আলোতেই সরাসরি এই বেচাকেনা করছেন। তারা ফোনে ও ডেকে ডেকে ক্রেতাদের নিয়ে আসে এবং মা ইলিশ বিক্রি করে।

প্রতিদিন শ্রিপুর, জাঙ্গালিয়া, নলচর, বাগরজা, কালিগঞ্জ, চন্দ্রমোহন ও লালখারাবাত এলাকার জেলেরা স্পিডবোট ও ট্রলারে করে এই চর কেউটিয়া বাজারে মাছ নিয়ে আসে। স্থানীয়দের ভাষায়, চর কেউটিয়া এখন ‘মা ইলিশের পাইকারি হাটে’ পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি বরিশালের বিভিন্ন নদী ও উপকূল এলাকায় মা ইলিশ ধরার ওপর প্রশাসনের অভিযানে কালিগঞ্জ, বাগরজা ও লালখারাবাত এলাকায় একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য এবং দিনের আলোতে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মা ইলিশ বিক্রির চিত্র দেখে ধারণা করা যায়, এসব হামলার নেপথ্যে চর কেউটিয়ার ইলিশ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটেরই ইন্ধন রয়েছে।
স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চর কেউটিয়ার ইলিশ চক্র তাদের অর্থ ও জনবল দিয়ে এসব এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, যাতে প্রশাসন ইলিশ ধরা বা বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে না পারে। একজন ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “চর কেউটিয়াকে কেন্দ্র করেই পুরো অঞ্চলে মা ইলিশ বিক্রির নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে টাকা ও লজিস্টিক সহায়তা যায় নদীঘাটের চক্রগুলোর কাছে।”
মৎস্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ অনুযায়ী, মা ইলিশ ধরা, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ বা বিক্রি—সবই দণ্ডনীয় অপরাধ। এই আইনের ৫ ধারায় বলা আছে, কেউ নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরলে বা বিক্রি করলে তার সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এই ঘটনাগুলো শুধু আইনের লঙ্ঘন নয়, দেশের জাতীয় সম্পদের বিরুদ্ধে সরাসরি অপরাধ। প্রশাসনের উচিত বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে এই চক্রের মূলহোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।”
চর কেউটিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষ জানিয়েছেন, প্রশাসনের অভিযান এলে এই চক্র আগেভাগেই খবর পেয়ে যায়। ফলে অভিযানের সময় খালি বাজার বা অচেনা জায়গায় মাছ সরিয়ে ফেলে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অভিযানের তথ্য ফাঁস হচ্ছে প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। মৎস্য বিভাগ ও প্রশাসনের যৌথ টিম শিগগিরই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে।”
মা ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। সরকার প্রতিবছর কোটি টাকা ব্যয়ে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ রক্ষায় অভিযান চালায়। কিন্তু চর কেউটিয়ার মতো কিছু এলাকায় এই আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইন প্রয়োগ, তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা নজরদারি- এই তিন দিকেই প্রশাসনের সমন্বিত ব্যবস্থা প্রয়োজন। নচেৎ এই অবৈধ বাণিজ্য থামানো সম্ভব হবে না। চর কেউটিয়ার মা ইলিশ বাণিজ্য এখন প্রশাসনের সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এই চক্রের প্রভাবে বরিশালের নদীগুলো আবারও ফাঁকা হয়ে পড়বে মা ইলিশে।
উল্লেখ্য: বড় বড় ইলিশ মাছ অভিযুক্তদের বাড়িতে ফ্রিজে মজুত করা হচ্ছে। অভিযান শেষের দিন রাতে কাভার্ড ভ্যানে করে মাছগুলো ঢাকা পাঠানো হয়। চড়া দামে বিক্রির উদ্দেশ্যে এই মজুত করছে অসাধু ইলিশ চক্র।











